খুলনায় রেলওয়ে স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে আছে ১১ বছরের মেয়ে বৃষ্টি। উশকোখুশকো কাপড় আর বিবর্ণ চেহারাই বলে দিচ্ছে ওর পরিচয়। সামনে এসে নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে আপনি সাংবাদিক। একটি আইসক্রিমের বিনিময়ে কথা বলা শুরু হয় বৃষ্টির সঙ্গে। দিনে রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরে ঘুরে পানির বোতল টোকাই আর স্টেশনেই রাত কাটে তার। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারানোর পর অসুস্থ অবস্থায় তার মা মারা যায়। পরে বৃষ্টির ঠাঁই হয় রাস্তায়।
একটু দূরেই ১৩ বছরের হাসানের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বাবাকে দেখেনি হাসান, মা মারা গেছে ২ বছর আগে। ট্রেনে যশোরের নওয়া পাড়া থেকে এসে খুলনা রেলস্টেশনে ঠাঁই হয়েছে হাসানের। সারা শরীরে কাটা চিহ্ন বলে দেয় অযত্ন আর অবহেলায় জীবন ওদের কাছে কতটা দুর্বিষহ।
হাসান বলে, স্টেশনে মানুষের ব্যাগ বহন করে কিছু টাকা দেয়। তা দিয়ে একবেলা খাই। আর একবেলা পাশের এক জায়গা থেকে খেতে দেয়। মাঝে মাঝে না খেয়ে স্টেশনে ঘুমিয়ে থাকি। কখনো কখনো কেউ খাবার নিয়ে আসে। কেউ ডেকে নিয়ে খেতে দেয়। দিনশেষে রাত হলে খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে এমন অর্ধশতাধিক পথশিশুর ঘুমন্ত চেহারায় সমাজে বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ওদের জীবনের অর্থ আর গল্প প্রায় একই।
এসব পথশিশুদের নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও শহরে ঠিক কী পরিমাণ পথশিশু রয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে। তবে, নগরী এবং নগরীর বাইরে থেকে আসা পথশিশুদের জন্য দুটি আবাসিক এবং একটি ডে-কেয়ার হাব চালু রয়েছে। ইউনিসেফের অর্থায়নে এসব পুনর্বাসনকেন্দ্রে দুই শতাধিক শিশুর পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও শুধু একবেলা নিম্নমানের খাবারের মধ্যেই দৃশ্যত এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ।
খুলনায় পথশিশুর সঠিক সংখ্যা জানে না পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়, বিভাগীয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দফায় দফায় এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পথশিশুর সংখ্যা জানা যায়নি। খুলনার রেলস্টেশন, ৫ নম্বর মাছ ঘাট, রূপসা নতুন বাজার, কাস্টমঘাট, ৭ নম্বর ঘাট, পুরাতন রেলস্টেশন এলাকার বিভিন্ন স্থানে বস্তি বা খোলা জায়গায় এসব পথশিশুর বসবাস।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সিএসপিবি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জিয়া উদ্দিন আহমেদের সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের অধীনে খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৮৫ পথশিশু তাদের পুনর্বাসনের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। খুলনা জেলায় সে সংখ্যা ২২৯। এ ছাড়া সমন্বিত পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় আবাসিক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আশ্রয় দেওয়া শিশুর সংখ্যা ১৫০।
এ ছাড়া খুলনা কদমতলা এলাকায় মহিলা অধিদপ্তরের (হাব) ডে-কেয়ারে ২৭ শিশু আশ্রয় দেওয়ার কথা বললেও সরেজমিন সেখানে মাত্র তিনটি শিশু দেখা যায়। বাকিরা কোথায় জানতে চাইলে প্রশিক্ষক সুমি বলেন, ওরা এখন নদীতে গোসলে গিয়েছে। দুপুরে খাবার খেতে চলে আসবে।
বিভিন্ন এনজিও ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা দেশে বর্তমানে ৪০ লাখের মমো পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে ৪০ হাজারের বেশি।
রাস্তার ড্রেনের মধ্যে হাত দিয়ে কিছু তোলার সময় হাত কেটে যায় পথশিশু রেজাউলের। খুলনা রেলস্টেশনেই থাকা রেজাউলের ওই হাতে ইনফেকশন হয়ে হাত বাতিলের উপক্রম। কোনো চিকিৎসা পায়নি রেজাউল। সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসেনি।
সমাজকর্মী জিয়া বলেন, পথশিশুদের ভাঙাড়ি ও ভিক্ষার কাজে বাধ্য করার একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় এ শিশুদের নিয়ে এলেও ভয়ভীতি দিয়ে আবারও সেই কাজে বাধ্য করার খবর পাই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, খুলনায় পথশিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তাদের সেবা দেওয়া হয় না।
খুলনার সমন্বিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রের উপপ্রকল্প পরিচালক বিপ্লব সাহা কালবেলাকে বলেন, আমাদের এখানে এই মুহূর্তে দেড়শ সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে। কিন্তু আমরা মূলত পথশিশুদের প্রাধান্য দিই। এ ছাড়া মিসিং শিশু, আদালতের মাধ্যমে পাওয়া শিশুও এখানে আশ্রয় পায়।